একটি গল্পের জন্ম
কৃষ্ণলাল সরকার
ব্যরাকপুর, ৭/২০১২
"আমার পেপসিকে নিয়ে একটা গল্প লেখনা বাবা।"
পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে নেহার আবদারে লেখক একটু মুচকি হেসে ফিরে তাকালেন তার দিকে।
"পেপসি ? দূর ওকে নিয়ে আবার গল্প হয় নাকি !ওকে নিয়ে কী গল্প হবে?"
-"ওসব আমি জানি না, এতো গল্প লেখো আর পেপসিকে নিয়ে লিখতে পারবেনা ? তোমাকে
লিখতেই হবে।"
বেণী দুলিয়ে,চোখ পাকিয়ে শাসানি মেশানো আবদার জানিয়ে যেমন দ্রুত এসেছিল তেমনি
তাড়াতাড়ি চলে গেল নেহা। লেখকের দিকে চেয়ে "ভোক" করে ছোট্ট একটু ডেকে উঠল,যেন
নেহার কথাতেই সায় দিল তার সর্বক্ষণের খেলার সঙ্গী পেপসি।
লেখকের আর উপায় নেই;মেয়ের আদেশ,গল্প ত একটা লিখতে হবেই।কিন্তু কোথা থেকে যে
শুরু করেন।কাগজ কলম নিয়ে বসাই সার হল। এইতো মাস ছয়েক আগের কথা,ছোট্ট কুকুর
ছানাটি তাদের বাড়িতে আসে। পুজার ছুটিতে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলেন সপরিবারে।
ফেরার পথে শিলিগুড়ির বিখ্যাত হংকং মার্কেট যাচ্ছিলেন মেয়ের জন্য বিদেশি খেলনা
নেবেন বলে। পাশে বিধান মার্কেট এর গলিতে ঢুকতে নেহাই প্রথমে নজর করে পেট শপ এর
দিকে। সেখানে রাখা কয়েকদিন বয়েসের দুধ সাদা স্পিৎজ
কুকুর ছানাটি। মেয়ের চোখ তো আর পারেনা।
“বাবা দেখো কি সুন্দর কুকুর বাচ্চা। কি cute, চাইনা আমার খেলনা, আমি এটাই নেব।”
আতএব তাই হল। এই ছোট্ট জ্যান্ত পুতুলটি একটি প্ল্যাস্টিকের বাস্কেটে চেপে
দার্জিলিং মেল এ উঠে বসল। তারপর নেহার মা অনুরাধা আর নেহার আদরে এই এত বড়টি
হয়েছে পেপসি। পেপসি নামটা নেহারই দেওয়া। পে – প – সি বলে ডাকলেই ছোট্ট “ভোক
ভোক” আওয়াজ তুলে এসে হাজির হয়। বাড়িতে এখন ওরই রাজত্ব। শীতে নেহার লেপ এর নিচে,
আর গরমে বাড়ির একমাত্র এসি বেডরুমে তার সারাদিন অধিষ্ঠান। তার জন্য দরকার না
থাকলেও এসি চালিয়ে রাখতে হয়। আর বর্ষাকালে ? ওহ হ সেটা বলা হয়নি। পেপসি যখন
বাইরে বেরোয় তখন তার গায়ে থাকে হলুদ রঙা রেনকোট। তা সেই পেপসির একদিন সাইকেল
চাপা পড়ে পা ভাঙল।
তারপর শুরু হল আর এ ক পর্ব। যথারীতি নেহার কান্নাকাটি আর অনুরাধার শুশ্রূষা
শুরু হল। অচিরেই বোঝা গেল ব্যপারটি ছোটখাটো নয়। এক্সরে করে দেখা গেল পেপসির
পিছনের পায়ের থাই এর হাড় ভেঙেছে। আতএব চলো ভেট – সার্জেন এর কাছে। পেপসি ভর্তি
হোল হাসপাতালে। ওহ কি নিদারুন সময় যে গেছে সেইসময়; নেহা আর পেপসি দুজনেরই। আর
হাসপাতালের বেড মানে তো ছোট্ট একটা খাঁচা; সেখানে বন্দি পেপসির পায়ে অপারেশান
করে প্লেট বসানো হল। সেখানে নেই ভিজিটিং আওয়ার। দূর থেকে দিনে একবার শুধু
দেখবার অনুমতি মেলে। নেহার মুখ কান্নাতে ফুলে আছে সবসময়। আবার এক বিপদ বাধালো
পেপসি এরপর মুখ দিয়ে পায়ের সব ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে পায়ের সেলাই কেটে ফেলার
জোগাড় প্রায়। অতহপর তার হাত পা বেঁধে রাখা হল যতদিন সেলাই না শুকোয়। অবশেষে
প্রায় তিন সপ্তাহ পরে পেপসি ঘরে এল।
-“মা , ও আমাদের ভুলে যাই নি তো?”
কিন্তু দেখা গেল নেহার সন্দেহ অমূলক। নেহার মুখে হাসি ফুটিয়ে একটু পরেই দুজনের
ভাব হয়ে গেল।
কিন্তু আসল কাজ আর হচ্ছে কোথায়। এত কাণ্ড চলছে পেপসি কে নিয়ে কিন্ত লেখকের কলমে
গল্প তো আর আসচে না। লেখকেরও চিন্তা কম নয়, তার মেয়ের তো বটেই, - “বাবা, তুমি
যে কী করছ ! এতদিন হয়ে গেল, তাও পেপসি কে নিয়ে গল্প লিখতে পারলে না?” ম্লান
হাসেন লেখক ।
-“কি করি বল তো মা। কিছুতেই যে তোর কুকুর গল্প বানাতে পারছে না।এক কাজ করি ...
” ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বলেন লেখক “পেপসি এখন বড় হয়ে গেছে, প্রায় দু বছর তো বয়েস
হল, আয় আমরা খুব ধুমধাম করে তোর পেপসির একটা বিয়ে দিয়ে দি। তাহলে বেশ একটা গল্প
হয়ে যাবে।” এই দু বছরে নেহাও সাত বছরে পড়েছে। সে এখন বিয়ে মানে কিছুটা বোঝে।
“ধ্যাৎ, তুমি যে কি ! বিয়ে হলে তো পেপসি পরের বাড়ি চলে যাবে, তারপর আর গল্প টা
কি করে হবে বলতে পারো?”
নেহা যখন স্কুল বাস থেকে নামে তখন পেপসির কাজ তাকে দৌড়ে গিয়ে সিঁড়ির গোঁড়া থেকে
অভ্যর্থনা করা। কতক্ষণ দেখা হয়নি তার মনিবা নির সাথে। নেহার কোলে উঠে তারপর তার
‘ভউ ভউ’ আদরের ডাক থামে। সেদিন স্কুল বাস আসতে অনর্থক দেরি হচ্ছিল, অনুরাধা
বারবার ঘর-বার করছিলেন। অসতর্ক মুহূর্তে সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে
ছিলেন। এমন সময় স্কুল বাস থেকে নেহা নামতেই পেপসি ছুট লাগায় তার দিকে। রাস্তা
পেরোতে গিয়েই হল সেই সর্বনাশ ! একটা প্রাইভেট কার এসে পিষে দিয়ে গেল তাকে।
নেহার আদরের পেপসি সত্যিই পরের বাড়ি চলে গেল আচমকা।
এই বিয়োগান্ত কাহিনি এর পরে আর লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছে হল না লেখকের। পেপসি কে
নিয়ে তার গল্প লেখার চেষ্টার এখানেই ইতি। কিন্তু নেহাকে যে আর বাগ মানানো
যাচ্ছেনা। কেঁদে কেঁদে ওই একরত্তি মেয়ে নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ করেছে। শুধু
একটাই বায়না। - “আমার পেপসি কে এনে দাও।” অবুঝ মেয়ে কোনো সান্তনাই মানে না। দিন
যায়, সপ্তাহ ঘুরে প্রায় এক মাস হতে চলল! তাকে তাও থামানো যায় না। অন্য কুকুর
ছানা কিনে দেবার প্রস্তাব হেলায় উড়িয়ে দিয়ে তার একটাই কথা “হবে না, হবে না। ওকি
পেপসি ? আমার পেপসিই চাই।”
-“কিছু একটা করো,” স্ত্রীর কথায় হুঁশ ফিরল লেখকের।
-“একটা কাজ করলে হয়, রানার সাথে কথা বললে হয় এ ব্যাপারে।” রানা লেখকের বহু
দিনের বন্ধু, সব ব্যাপারে চৌকশ। “ও ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দেবে।”
-“তাই যাও, কিছু একটা তো করতে হবে।” লেখক তক্ষনি ছুটলেন সব কাজ ফেলে। - “হয়ে
যাবে একটা ব্যবস্থা।” সব শুনে মুস্কিল আসানের ভঙ্গিতে বলল রানা। “আমি আজ
সন্ধেবেলা যাচ্ছি তোদের বাড়ি। সন্ধেবেলা প্ল্যানচেট এর আসর বসাব। পেপসির আত্মা
নামাব।” শুনে লেখক বিষম খান আর কী!
-“সে কী? তুই কুকুরের আত্মা নামাবি ? তুই কি এইসব ও বিশ্বাস করিস?”
-“হ্যাঁ বন্ধু। তুই এইবার আমাকে একটু বিশ্বাস কর – সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তার
আগে আমাকে একটু হোমওয়ার্ক করতে হবে, তুই এখন নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি যা।” রানা
হাবেভাবে এখন যেন ব্যোমকেশ বক্সী।
সন্ধেবেলা বেশ ঘটা করে প্ল্যানচেট এর আসর বসল। তার আগে রানা নেহাকে প্ল্যানচেট
সম্বন্ধে একচোট বুঝিয়েছে।
-“কাকু, পেপসি কথা বলবে?”
-“দেখনা কী হয়, তুমি শুধু চোখবুঝে একমনে পেপসির চিন্তা করতে থাকো।” আলো নিভিয়ে
ছোট্ট মোমবাতির আলোতে বসল প্ল্যানচেট এর আসর। রানা নিজে হলেন মিডিয়াম।
কিন্তু পেপসির আত্মা নামল না। প্ল্যানচেট ফেল।
-“তুমি কিচ্ছু পারোনা কাকু”, আভিমানী নেহার অনেক আশায় জল পড়ল যেন। কিন্তু রানার
মুখ দেখে মনে হল এই ফল তার কাছে প্রত্যাশিতই ছিল।
-“আরে আত্মা নামেনি সেটা তো ভাল। তার মানে পেপসি আবার জন্ম নিয়েছে।”
-“কোথায়? কোথায়?” নেহা এবার ভীষণ উত্তেজিত আর আনন্দিত।
-“ধৈর্য ধরো নেহা,আমি মেডিটেশন – এ বসে এক্ষুনি জানিয়ে দিচ্ছি।”
লেখক এবার তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন। স্মিত হেসে যেন রানার বুদ্ধির তারিফ
করলেন। মিনিট কয়েক বাদেই রানার মেডিটেশন শেষ হল।
-“পেরেছি নেহা, তোমার পেপসির খোঁজ পেয়েছি।”
-“কোথায় আছে সে, এক্ষুনি চলো তাকে নিয়ে আসি।” নেহা তখনই লাফাতে শুরু করেছে।
-“শান্ত হও মা, পেপসি এখন ছোট্ট একটা বাচ্চা হয়ে যাদবপুরের এক পেট শপ এ আছে।
এখন তো রাত হয়ে গেছে, কাল সকালেই আমরা গিয়ে নিয়ে আসব তাকে, কেমন?”
নেহার যেন আর তর সইছেনা, সেই কোন সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে তৈরী হয়ে বসে আছে
আর ঘর-বার করছে। রানাকাকু এল গাড়ি নিয়ে প্রায় নটায়, তারপর সবাই চললেন যাদবপুর।
দেখা গেল রানা দোকান টা ভাল মতো চেনেন। দোকানের মালিক ও তার পূর্ব পরিচিত।
কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশই হতে হল।
-“রানাবাবু, একবার আপনি আমাকে ফোন করলেন না ? তাহলে বাচ্চাটা আমি রেখে দিতাম।
কাল সন্ধেবেলা ওটা বিক্রি হয়ে গেছে।”
-“তাহলে কি হবে?” নেহা এবার কেঁদেই ফেলল। “আমি কিচ্ছু জানিনা। আমার পেপসি কে
কেন আর একজন নিয়ে যাবে, আমি ওকেই চাই।”
দোকানের মালিক কে ডেকে রানা সব জানালেন। মায় প্ল্যানচেট করা পর্যন্ত। তারপর
নেহা কে আশা দিয়ে নিয়ে আসা।
-“আপনি কিছু একটা করুন।”
দেখছি রানাবাবু। আমার দোকানের কাস্টমারদের বেশির ভাগই আমার চেনা, দেখি ফোন
নাম্বার নিশ্চয়ই আছে।
দেখা গেল যে ভদ্রলোক কুকুর ছানাটি কিনেছেন তিনি হাওড়া থাকেন। এবার গন্তব্য
সদলবলে হাওড়া। ভদ্রলোক প্রথমে কিছুতেই রাজী হচ্ছিলেন না। এই এক রাতের মধ্যে
ছোট্ট, স্পিৎজ এর ছানাটি তাঁকে মায়ায় বেঁধে ফেলেছে। “একে আমি কী করে দিই বলুন
তো?” কিন্তু তিনিও হার মানলেন নেহার কান্না ও আবদারে। “নাও মা, তোমার পেপসি
তুমিই নাও।” বদলে রানা প্রায় একই বয়সী একটা সাদা স্পিৎজ এর বাচ্চা জোগাড় করে
দিলেন ভদ্রলোককে।
-“মা দেখেছো, কেমন আমাকে চিনতে পেরেছে। আমার কোলে উঠে একদম শান্ত হয়ে বসে আছে।
কেমন তাকাচ্ছে আমার মুখের দিকে তাই না মা? দেখ দেখ ওর কানটা, আর চোখ দুটো। কেমন
আগের মতো তাই না? ” এক নাগাড়ে কলকল করে কথা বলে যাচ্ছে নেহা। আজ প্রায় একমাস
পরে তার চোখমুখে আনন্দ যেন উপছে পড়ছে।
লেখক রানার হাত চেপে ধরলেন। “তুই আমাদের বাঁচালি ভাই। ধন্য তোর বুদ্ধি।”
ছোট্ট কুকুর ছানাটি ধীরে ধীরে নেহার কোলে বড়ো হয়ে উঠতে লাগল। ‘পে – প – সি’ বলে
ডাকলে একছুটে লেজ নাড়াতে নাড়াতে ‘ভৌ ভোক’ করে নেহার কোলে উঠে পড়ে।
এই পর্যন্ত পড়ে লেখক থামলেন। “বাজে গল্প বাজে গল্প” নেহা লাফিয়ে উঠল। “পেপসি
মোটেই মরেনি, এই তো পেপসি আমার কাছে। দেখছ মা বাবা কেমন মিথ্যে কথা লেখে।”
অনুরাধা মুচকি হাসলেন, “তোমরা লেখকেরা পারোও বটে।”
পেপসি কী বুঝল কে জানে! সেও মৃদুস্বরে ডেকে উঠল, “ভোক ভোক, ভৌ ......”
---------------------